যে কারণে বোবার কোন শত্রু নেই

... 

হঠাৎ করেই আমি বোবা হয়ে গেলাম। 

বিষয়টা আমি প্রথম খেয়াল করি নূরজাহান রোডের জ্যামে বসে৷ এমনিতে আমি কথা কমই বলতাম৷ বেশি কথা বলা আমার ধাতে ছিলো না কখনোই৷ কথা যে বলতাম না,  তা নয়৷ বলতাম৷ তবে নিজের সাথে। নিজের সাথে কথা বলতে তো আর শব্দ করতে হয় না৷ মনে মনেই চলে কথোপকথন৷ আমার প্রেমিকা এ নিয়ে আমার উপর যারপরনাই বিরক্ত ছিলো৷ তার একটাই আক্ষেপ ছিল আমাকে নিয়ে, "তুমি কোন কথা বলো না কেন?" 

কিন্তু ঠিক কী বিষয়ে কথা বলা যায়,  সেটা আমি ভেবে পেতাম না৷ আমি যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি, সেগুলো কি তার ভালো লাগবে? আমি যদি তাকে বলি, "আচ্ছা কাফকাকে নিয়ে লেখক সমাজে এই যে উল্লাস, সেটা কে কি তোমার মেকি মনে হয় না?" সে কী উত্তর দিতো আমার প্রশ্নের? তাই দেখা যেতো আমি কথা কম বলছি বা বলছিই না একেবারে৷ তার মানে কিন্তু এই নয় যে আমার কথা পছন্দ নয়। কথা শুনতে আমার বেশ লাগে৷ এই যেমন, আমার প্রেমিকা যখন কথা বলে তখন তার ঠোটের ওঠানামা, নাকের ফুলে ওঠা কিংবা যত্ন করে ছেটে রাখা দুই ভ্রুয়ের মাঝখানটা কুঞ্চিত হয়ে যাওয়া - সব কিছুই আমার ভালো লাগে৷ 

আমি কিন্তু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেও পছন্দ করি৷ কিন্তু আড্ডাতেও আমি বিশেষ একটা কথা বলি না৷ শুধু শুনি আর দেখে যাই৷ মাঝেমধ্যে কথা বলার যে চেষ্টা করি না, তা কিন্তু নয়৷ তবে মনে হয়, কথা গুলো ঠিক খাপ খায়না৷ সুজির হালুয়ার মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা এলাচির মত বিরক্তি উদ্রেক করে ওগুলো৷ এর থেকে ভালো কথা না বলে থাকাটা৷ 

আমি কথা কম বলি বা একদম বলি না, তার মানে এই না যে আমি কথা বলতে পারি না৷ কিন্তু এই মুহুর্তে ব্যাপারটা সেরকই ঘটছে৷ 

নূরজাহান রোডের জ্যামে, যেখানটাতে আড়াইবারের মত ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছি, সেখানে বসে রিকশাওয়ালার মুখ থেকে সদ্য নিঃসৃত একটা গালির অরিজিন নিয়ে নিজের সাথে কথা বলছিলাম। রিকশাওয়ালা তারই মত আরেক রিকশাওয়ালার রিকশায় অত্যন্ত কাব্যিক ভাবে রিকশার চাকা বাজিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, "হালারপো হালা, ঢাকায় নতুন আইছস?" অপর জন ঢাকায় কত দিন ধরে এসেছে সে নিয়ে আমার কোন আগ্রহ তৈরি হলো না৷ আগ্রহ জাগলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বিষয়ে৷ ঠিক কবে থেকে হালা মানে শ্যালক গালি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? বা কেন হচ্ছে? 

শালাকে তুচ্ছার্থে দেখার কারণ কোথায় নিহিত আছে? এটাকে আমরা প্রায়শই গালি হিসেবে ব্যবহার করি৷ কিন্তু কেন করি? 'গালি অভিধান' নামে একটা বই আছে৷ সেখানে খুঁজে দেখতে হবে এই শ্যালকের মত একটা ভদ্র সম্পর্ক কেন গালি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার কোন হদিস পাওয়া যায় কিনা। 

জ্যামের অতিশায্যেই হোক বা মৃদু তর্ক বিতর্কের জন্য হোক, আমার রিকশাচালক ভুল দিকে মোড় নিলো৷ এই মুহুর্তে আমার রিকশাচালককে বলা দরকার, "ডানে নয় বামে যাও৷" এই কথা বলতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম আমার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না! আমি মুখ নাড়াতে পারছি কিন্তু মুখ থেকে কোন শব্দ নিঃসৃত হচ্ছে না৷ আমি চীৎকার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন ফল হলো না৷ মনের মুখ কিন্তু বোবা হয় নি৷ সে ঠিকই ব্যস্ত হয়ে গেছে নানামুখী হিসেব কষতে৷ কথা বলে চলছে অনবরত৷ কিন্তু আমার বাগযন্ত্র বিকল হয়ে গেছে,  অন্তত এই মুহুর্তের জন্য। 

আমার মনের ভিতরকার বাকপটু বক্তা কী কথা বলছে শুনে আসা যাক৷ রিকশা চলতে থাক বামের বদলে ডান দিকে। সে এখন ব্যস্ত এই আকস্মিক ঘটনার সম্ভাব্য অসম্ভাব্য ফলাফল বিশ্লেষণে। ধরা যাক, আর কখনো শব্দ করতে পারবো না আমি৷ তাতে কী খুব বেশি ক্ষতি হবে? মনে হয় না। সব সময় তো চুপ করেই থাকি৷ মাঝে মধ্যে যে হু-হা-জ্বি-জ্বি করি, সেটা না করলেও খুব বেশি ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। 

আমার প্রেমিকার এটা বুঝতে কতদিন সময় লাগবে? কতদিন আড্ডা দেয়ার পর আমার আড্ডাবাজ বন্ধুরা বুঝবে যে আমি পাকাপাকি ভাবে বোবা হয়ে গেছি? আমি নিশ্চিত নই। আমার এখন কী করা উচিত? চিকিৎসকের কাছে যাওয়া? কিন্তু এটা কী কোন রোগ? আমার তো মনে হচ্ছে ,  এটা কোন রোগ নয়৷ অতি স্বাভাবিক ঘটনা। চুপ করে থাকাটা কী স্বাভাবিক নয়? মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী তো এতো অকারণ কথা বলে না৷ কথা না বলাটাই তো প্রাকৃতিক। এই যে আমি কথা বলতে পারছি না, এতে রিকশাচালকের রিকশা চালিয়ে নিতে কী কোন অসুবিধা হচ্ছে? না, হচ্ছে না৷ যদিও আমি চলছি ভুল রাস্তায়, গন্তব্যে পৌছাতে পারি দিতে হবে দীর্ঘ ঘুরো পথ৷ কিন্তু চলছি তো! আমার বোবা হয়ে যাওয়াতে রিকশার চাকা তো থেমে যায় নি। 

কিন্তু অন্যদিকে আমি আতঙ্কিত হচ্ছি৷ আমি চীৎকার করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আমি হয়তো কিছুই বলতে চাই না৷ শুধু একবার শব্দ করে চীৎকার করতে চাই৷ কিন্তু আমি বোবা হয়ে গেছি৷ নূরজাহান রোডের জ্যামে বসে আমি আবিষ্কার করেছি যে আমি বোবা হয়ে গেছি৷ 

আমি যে আমার প্রেমিকার সাথে কথা বলতে চাই না, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। আমিও কথা বলতে চাই, কিন্তু কথা গুলো মুখ পর্যন্ত এসে বাতাস হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়৷ আমি যে বন্ধুদের সাথে দু চারটে বিষয়ে সক্রিয় আলাপ করতে চাই না, তাও নয়৷ কিন্তু কথা গুলো মস্তিষ্ক থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজে পায় না, আটকে যায় কোন দুর্বোধ্য অলঙ্ঘনীয় সীমানা প্রাচীরে৷ কিন্তু আমি এটুকু জানতাম যে, আমি চাইলে বাতাস হবার আগেই কথা গুলোকে শব্দে পরিণত করতে পারবো৷ আমি নিশ্চিত ভাবেই জানতাম যে, একটু চেষ্টা করলে সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলাটা খুব কঠিন কিছু হবে না। সেটাই আমার ভরসার জায়গা ছিলো আসলে। ভেবেছি, কোন একদিন ঠিক সময় এলে কথার ঝাপি নিয়ে সমস্ত প্রাচীর দেয়াল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবো৷ কিন্তু এখন? এখন তো আমি বোবা হয়ে গেছি৷ এখন কি আমি চাইলেও পারবো চীৎকার করে উঠতে? ভালোবাসি বলে প্রেমিকার কানের কাছে ফিসফিস করতে? ধুসশালা বলে কোন বন্ধুকে আরো বিচ্ছিরি কোন গালিতে ঘায়েল করতে? ভুল করে ডান দিকে মোড় নেয়া রিকশাটাকে ধমক দিয়ে বাম দিকে নিয়ে যেতে? পারবো না। 

আমার মনের অভ্যন্তরে যে বাকপটু বক্তা, সে কিন্তু তার হিসাবে ক্ষান্ত দেয়নি। এখন সে উদ্ধার করার চেষ্টা করছে আমার বাকযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ার পিছনের গূঢ় রহস্য গুলো৷ এমন কেন হবে? এমন কি হয়? হতেই তো পারে,  এমনটাই হয় হরহামেশা। আমাদের চারপাশে কত কত মানুষ। সবাই তো কথা বলছে না। বেশিরভাগই তো চুপ করে আছে। অথবা কে জানে কথা বলছে নিজের সাথেই। তাদের দিকে আমরা লক্ষ করি না দেখে হয়তো বুঝতে পারি না,  তারাও বোবা, আমারই মত। তাতে কি তাদের কোন ক্ষতি হচ্ছে? হ্যাঁ, হয়তো তাদের রিকশাও মাঝেমধ্যে চলে যাচ্ছে উলটো পথে, হয়তো তারাও কারো গালাগালির বদলে পালটা গালি দিতে পারছে না। কিন্তু তাতে কী? 

আমি কেন বোবা হয়ে গেলাম? তবে কি অব্যবহারে অব্যবহারে আমার বাকযন্ত্র বিকল হয়ে গেছে? যদি কথা বলতাম সব সময়, যখন দরকার থাকে কথা বলার,  তাহলে কি এমন হতো না? বিষয়টা নিয়ে এখন গবেষণা করার সুযোগ নেই। কারণ আমি বোবা হয়ে গেছি৷ সম্ভবত বড্ড দেরি হয়ে গেছে৷ এইমাত্র নূরজাহান রোডের জ্যামে বসে আমি আবিষ্কার করেছি আমার কথা বন্ধ হয়ে গেছে৷ 

আমি এখনো গন্তব্যে পৌছাইনি। রিকশাওয়ালা চলছে ডান দিকে। আমার মুখ থেকে বের হচ্ছে না কোন শব্দ৷ আমি তখন মনে মনে বুঝে ফেললাম যে আমি চিরতরে বোবা হয়ে গেছি। এবং সাথে সাথে এটাও বুঝে ফেললাম যে,  এ সকল কারণেই বোবার কোন শত্রু থাকে না।

মন্তব্যসমূহ