সাক্ষাৎ

তিন ইঞ্চি সাইজের কলার খোসাটা জানালা দিয়ে ফেলে দিতেই, পাশে বসে থাকা মুরুব্বি বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকালো লোকটার দিকে। কৈফিয়তের সুরে লোকটি বললো, “ফেরির জানালা দিয়া কিছু নিচে ফালাইলে সেইটা ভিতরে পড়েনা, এক্কেরে পানিতে গিয়া পড়ে। আমি পরীক্ষা কইরা দেখছি।” মুরুব্বি সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হচ্ছেনা। বিচিত্র রঙের পোশাক পড়া লোকটি নিজের উত্তর আরো শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে পরবর্তী ব্যাখ্যা হাজির করলো, “বিশ্বাস করেন নাই? আমি নিজে জানালা দিয়া ছ্যাপ ফালাইয়া দেখছি। ছ্যাপ ভিতরে না পইড়া, সোজা পানিতে গিয়া পড়ছে।” এমন অকাট্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপস্থাপন করার পরও মুরুব্বির মন বিগলিত হলো না।

ছ্যাপ এবং কলার ছোলা ফেরির জানালা দিয়ে নিচে ফেললে আসলেই সেগুলো সোজা পানিতে গিয়ে পড়ে কিনা, সেটা দেখার অদম্য ইচ্ছা তৈরি হল আমার। তবে আপাতত সেই ইচ্ছাকে দমিত করে ছাদে গিয়ে হাওয়া খাবো বলে মনস্থির করলাম। সত্যিকার অর্থেই ‘হাওয়া’ খাওয়ার জন্য এগারো টাকার বেনসন অ্যান্ড হেজেস পনের টাকা দিয়ে কিনে ছাদে উঠে গেলাম। নদীর স্বাস্থ্যকর বাতাসে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগলো নিমিষেই। আমার ধুলি-ধূসরিত স্যান্ডেলের দিকে একনজর তাকিয়ে এক ভ্রাম্যমান মুচি আমাকে সাত জনমের আবেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মামা কালি লাগবো, কালি?”

কিন্তু আমার শূন্য দৃষ্টি তখন ফেরির ভাঙা চেয়ার আয়েশ করে বসে থাকা একটি আপাত সুখী পরিবারের দিকে। কর্তা-গিন্নী আর দুই ছেলেমেয়ে। কর্তার কুঞ্চিত ভ্রু বেয়ে রাজ্যের বিরক্তি শিশির বিন্দু হয়ে বেড়িয়ে আসছে। গিন্নী ব্যস্ত নদীর রসিক হাওয়ার দাপট উপেক্ষা করে তার অবিন্যস্ত চুল গুলো ঠিক করার পবিত্রতম কাজে। ছেলেমেয়ে দুটির হাতে মিস্টার টুইস্টের প্যাকেট। ওগুলো বোম্বে সুইটসের কিনা জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হত। আজকাল বাজারে দু নম্বরী মিস্টার টুইস্ট রাজত্ব করছে। তবে আমার প্রিয় ছিল পটেটো ক্র্যাকার্স। এই বাচ্চা দুটো কি পটেটো ক্র্যাকার্স পছন্দ করে? জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।

আমি যাচ্ছি আমার অমোঘ গন্তব্যে। সব থেকে পরিচিত, সব থেকে কাঙ্ক্ষিত কিন্তু সব থেকে অপছন্দের শহর- ঢাকাতে। দু দিনের সফরে আমি গিয়েছিলাম ‘তার’ সাথে দেখা করতে। সত্যি কথা বলতে আমার যাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা খুব একটা। না ভুল বললাম বোধ হয়। ইচ্ছা না থাকলে কেউ তো আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারতো না। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায়, স্বেচ্ছায় গিয়েছি সেখানে। না গেলেও পারতাম। তবে আমার মধ্যে যতটা না ‘তার’ সাথে দেখা করার তাড়না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল নতুন একটা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর উত্তেজনা। নতুন যে কোন জায়গা দেখতে, সেখানকার মানুষ গুলোকে পড়তে আমার সব সময়ই আবিষ্কারের আনন্দ হয়।

‘তার’ সাথে কত বছর পর দেখা হলো? খুব সম্ভবত পাঁচ কি ছয় বছর হবে। পাঁচ ছয় বছর মোটেও দীর্ঘ সময় নয়।তবে অবশ্যই দীর্ঘ মুহুর্ত। মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দিতে কেবল একটি মুহুর্তই যথেষ্ট। এক সময়ের অনেক কাছের মানুষকে অনেক দিন পর দেখার মধ্যে এক ধরণের শিহরণ কাজ করে। একই সাথে কাজ করে ইচ্ছা আর অনিচ্ছা। এই দ্বিমুখী টানের মধ্য দিয়ে আমি শেষ পর্যন্ত যেতে বাধ্য হলাম সেখানে।

নতুন যেকোন শহর আমাকে আবিষ্কারের আনন্দ দেয়। সেই ভ্রাম্যমান মুচির মত একই কথার পুণরুক্তি করলাম।সে যাই হোক, নতুন সেই শহরে প্রবেশ করে নতুন কিছু খুঁজে পাবার আশায় এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি সেখানে রাজ্যের নিরবতা। ভুতপ্রেতের শহর নয় অবশ্য। ঘটনা হচ্ছে সেদিন ছিল শুক্রবার, আর এই শহরের মানুষ জন খুব সম্ভবত একটু বেশিই ধর্মপ্রাণ। নামাযের প্রস্তুতি হিসেবে তারা হয়তো এবেলা ঘুমিয়ে নিচ্ছে দু দন্ড। দোকানপাট বন্ধ। বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশস্ত রাস্তায় গুটি কয়েক যানবাহন। একটি ভিক্ষুক। আর একজন জীবনের উপর তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে নিশ্চল বসে থাকা চা-ওয়ালা।

নির্ধারিত ঠিকানায় পৌছাতে যানবাহনের সাহায্য নিতে হলো। সাধারণ নতুন কোন জায়গাতে এলে আমি হেঁটে হেঁটেই জায়গাটাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। সত্যি কথা বলতে, না হাঁটলে কোন জায়গাই ভালো মত দেখা হয়না, চেনা হয়না। কোথাও গিয়ে যদি সেখানকার ধুলোতে প্যান্টের তলা সাদা না হয়, সেখানকার মানুষের শরীরের সাথে ধাক্কা না লাগে - তবে কি জায়গাটি কে ভালো মত চেনা হয়? হয়না। কিন্তু এখন ধুলো কিংবা শরীর কোনটির সংস্পর্শে আসাই সম্ভব হচ্ছেনা। কারণ, প্রথমত, আমার হাতে সময় খুব কম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জায়গাটাকে পরখ করে নেয়ার মত সময় আমার নেই। দ্বিতীয়ত, প্রচন্ড রোদ্দুরে হেঁটে হেঁটে নতুন শহর আবিষ্কার করার মত রোমান্টিসিজমটা এই মুহুর্তে নেই।

আমি যে রিকশায় উঠেছি সেটা মানুষের বুদ্ধিমত্তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। এমনিতে পায়ে টানা রিকশায় মেকানিজমটাও দারুন, কিন্তু এতে কায়িক শ্রম দিতে হয় প্রচুর। এখানে দেখছি মানুষ রিকশার সাথে ইঞ্জিন লাগিয়ে নিয়েছে। সময় সাশ্রয়, কায়িক শ্রম নেই আবার রিকশা ভ্রমণের অনুভূতি- সব একসাথে। এই জিনিস কিছুদিন ঢাকার রাস্তাতেও চলেছিল। পরে কোন আমলাতান্ত্রিক বা কামলাতান্ত্রিক জটিলতায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এই রিকশা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। এটাকে ঠিক রিকশা বলে মনে হচ্ছেনা। ১৫ বছরের একটি কিশোরীকে মেকআপ- পোশাকের কারসাজিতে জোর করে তরুণী বানানোর যে অপচেষ্টা টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে লক্ষ করা যায়, এই ইঞ্জিন চালিত রিকশা গুলোকেও আমার ঠিক সেরকমই মনে হচ্ছে। রিকশা-চালকের প্যাডেল চাপার সাথে সাথে যে একটা ঝিমুনি ভাব আসে, এই রিকশাতে সেটা নেই। সব সময় তটস্থ হয়ে থাকতে হয়।

যন্ত্রচালিত ত্রি-চক্রযানে করে অবশেষে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌছালাম। ‘তার’ সাথে দেখা হবার মুহুর্তটি উপস্থিত। আমি কী বলবো, কিভাবে বলবো - সেগুলো নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি চুপ করে থাকাটাই সব থেকে ভালো উপায়। মৌনতা জ্ঞানের লক্ষণ। সে একা আসেনি, তার সাথে তার স্বামীর আসার কথা। সেই লোকটির সাথেও বা আমার কথাবার্তা কেমন হবে, ঠিক বুঝতে পারছিনা। মৌনব্রত অবলম্বন করলে সেটাকে অপমান হিসেবেও ধরা হতে পারে। অবশ্য এই ব্যক্তি অপমানিত বোধ করলে,তাতে আমার বিশেষ কোন সমস্যা নেই।

এটা একটা পার্কের মত জায়গা। ছোটদের খেলার জন্য বিভিন্ন বিকট-দর্শন মন খারাপ করা সরঞ্জাম দেখা যাচ্ছে এখানে। আছে সিমেন্টের বাঁধাই করা বসার বেঞ্চি। পার্ক ব্যাপারটাকে পূর্ণতা দান করতে এই সকালেও এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাদাম-ওয়ালা আর বাতাসা-বিক্রেতা। এরা দুজন মনে হয় আবার পূর্ব পরিচিত। ক্রেতা নেই দেখে নিজেরাই নিজেদের জিনিস অদল-বদল করে নিচ্ছে সম্ভবত। বাদাম ওয়ালার হাতে বাতাসা, আর বাতাসা-ওয়ালার হাতে বাদামের খোসা দেখতে দেখতে আমি ‘তাদের’ ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম।

মোবাইল ফোনটা জ্যান্ত হয়ে উঠে জানান দিল তারা চলে এসেছে। হুম, ঐ তো, প্রবেশ ফটকে দেখা যাচ্ছে তাদের। সে,আর তার স্বামী। আমার ইচ্ছা হচ্ছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যাই। আমার মধ্যকার সেই দ্বিমুখী স্বত্বা আবার নিজেদের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। তবে এসেই যখন পড়েছি, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের জীবনে সব কাজ আমরা নিজেদের ইচ্ছাতে করিনা, বেশির ভাগ কাজ আমরা করি অবচেতন মনের ইচ্ছায়, যার উপরে আমাদের সচেতন স্বত্বার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

সে আমার কাছাকাছি আসতেই আমি হাসি দিলাম, অথবা বলা যেতে পারে, হাসির মত একটা মুখভঙ্গি করলাম। তার অশ্রুসজল হাসি মাখা মুখ আমার ভিতরে দীর্ঘদিনের চেপে রাখা কষ্টের স্রোতটাকে ধাক্কা দিতে থাকলো ক্রমাগত। সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার স্বামী লোকটি দ্বিধান্বিত হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমিই তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলাম বা বলা যেতে পারে হাসির মত মুখভঙ্গি করলাম। সে এগিয়ে এসে হাত মেলালো। পোস্ট-মডার্ন সোসাইটির কুশলাদী জিজ্ঞাসার প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ হবার দেখা গেল, আমাদের কারোরই আসলে তেমন কিছু বলার নেই। অথবা অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু বলা নিরর্থক দেখে হয়তো কথা গুলো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।

“ভালো আছোতো? শুনলাম তোমার শরীর নাকি খারাপ?”
“ ঐ আর কি।”
“ডাক্তার কী বলল?”
“ ঐ আর কি।তেমন কিছুনা।”
“পড়াশুনা চলছে কেমন?”
“ ঐ আর কি। চলছে।”
“আসতে কষ্ট হয়নি তো?”
“ ঐ আর কি। কষ্ট আর কই।”

কষ্ট যে কোথায়,সেটা উভয়পক্ষই জানে। কিন্তু ভাগ্য আমাদের কোথায় কোথায় নিয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে স্বয়ং স্রষ্টাও কতটুকু নিশ্চিত, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এভাবে কথার পিঠে কথা চলে। বাতাসার সাথে উড়ে যায় শুষ্ক বাদামের খোসা।

শহরের বেশ সুদর্শন এক হোটেলে আমরা খাওয়া-দাওয়া করলাম। যে কোন নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার বিশেষ খাবার গুলো পরখ করে নেয়াটাও আমার ভ্রমণ তালিকার অংশ। তবে এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে পারলে শান্তি পাবো, তাই খাবারের দিকে মন নেই। মনে তীব্র অস্বস্তি থাকলে, জিহবাতে স্বাদ লাগেনা। স্বাদ-ইন্দ্রিয় গুলো তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অস্বস্তির সাথে বোনাস হিসেবে আছে কষ্ট। কষ্টে গলা ভরে গেছে, খাবার গিলবো কিভাবে?

সে কী কী বলছে, আমার কানে ভালো মত প্রবেশ করছেনা কথা গুলো। যেন মহাজাগতিক কোন দুুর্বোধ্য সংকেত, কোন বিজাতীয় ভাষা। খেতে খেতে আমি ভাবছি বাসে যাব নাকি ট্রেনে? বাস জার্নি আমার কষ্টকর লাগে। এক জায়গায় ঠায় বসে থাকাটা অত্যন্ত বিরক্তিকর। ট্রেন জার্নি এর থেকে যথেষ্ট ভালো। অনেক রকম মানুষ দেখা যায়, হাঁটাচলা করা যায়, চারপাশ দিয়ে হুশহুশ করে ছুটে যাওয়া দৃশ্য গুলো উপভোগ করা যায়। কোন অপরিচিত স্টেশনে যাত্রাবিরতীতে এক কাপ ধূমায়িত চা পাওয়া যায়।

“কী চিন্তা করছ?”
“নাহ কিছুনা। ভাবছি মঙ্গল গ্রহে মানুষের ভবিষ্যৎ কী? তারা কি আসলেই সেখানে বসতি স্থাপন করতে পারবে?”
“তোমার ফাজলামি করার স্বভাব যায় নাই এখনো।”

স্বভাব আসলে যায়না। বিশেষ পরিস্থিতিতে, কোন কোন বিস্মৃত স্বভাব আবার নতুন করে সামনে চলে আসে, পুরনো মানুষটিকে খুঁজে পায়। ঠিক এখন যেমন আমি পাঁচ ছয় বছর কিংবা তারও অনেক আগে ফিরে গিয়েছি। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তার সঙ্গ আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। অস্বস্তি ভাবটা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কষ্টের জায়গা গুলোতে বসে পড়ছে পুরনো সুখ স্মৃতি গুলো। ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে কিনা আমি নিশ্চিত নই। কারণ এই মুহুর্তটা সাময়িক, খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। তারপর আবার আমরা ফিরে যাব যে যার নিজস্ব জায়গায়।

দিনটি পনের মিনিটের শর্ট-ফিল্মের মতই ছিল। আমরা সারাদিন একসাথেই ছিলাম। একসাথেই ঘুরেছি শহরটাতে,তবে শহরটা দেখা হয়নি দেখার মত করে। ‘আমরা’ বলতে, আমি,সে আর তার স্বামী। লোকটির মধ্যে কি কোন অপরাধবোধ কাজ করছে আমাকে দেখে? তার আচরণে তাই মনে হচ্ছে। আমাকে এমন ভাবে আপ্যায়নের চেষ্টা করছে যেন সে এই শহরের সুলতান,আর আমি হিউয়েন সাং!

আমি এখন আর মুহুর্ত গুলো থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছি না। বরং সেগুলো উপভোগ করার চেষ্টা করছি, যেন নোংরা শহরে ফিরে গিয়ে, একগাদা নোংরার মধ্যে ডুবে থেকেও, এই স্মৃতিগুলো মনের সেলুলয়েডে চালিয়ে দিতে পারি, সহস্র রত্নের মত দামী এক টুকরো হাসি মুখের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে। এই সাক্ষাৎ-টা ঠিক হল কিনা নিশ্চিত নই, কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, জরুরী ছিল। জরুরী ছিল কারণ মানুষের সহ্যশক্তি অসীম। দেখা না হলে, না দেখা হওয়াটা অভ্যাস বানিয়ে ফেলে, কষ্টটাকে সহ্য করে নেয়ার উপায় রপ্ত করে ফেলতাম। এখন আরো কিছুদিনের জন্য হলেও স্মৃতি গুলো আমার সঙ্গী হবে।

দেখতে দেখতে দিনটিও শেষ হয়ে আসছিলো। শহরের খুব কাছেই নদী। আর এখানে ব্যাটারী চালিত যানবাহনে বিদ্যুৎ দূষণ হলেও, বায়ু দূষণ কিছুটা কম। তাই বাতাস ধ্যানমগ্ন সাধুর মত নির্মল। সূর্য বিশাল দালানের ওপাশ দিয়ে সম্ভবত নদীর দিকেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই সে চলে যাবে অন্য গোলার্ধে।যেতে হবে আমাদেরও। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বিদায় নেয়ার মুহুর্তে মনে হচ্ছে আরো কিছু সময় একসাথে থাকতে পারলে মন্দ হতনা। মনে হচ্ছে এই সময় যেন দীর্ঘায়িত হয়, দালানের ওপাশে সূর্যটা যেন ওখানেই থেমে থাকে নিশ্চল হয়ে। ‘কিন্তু তারপরও পৃথিবী ঘুরছে’, তাই আমাদের বিদায় নিতেই হবে।

একগাদা জিনিস-পত্র সে আমাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিয়েছে এই শহরের সব থেকে দামী বিপণিবিতান থেকে। টাকাটা যেহেতু তার স্বামীর, তাই জিনিস গুলো নেয়া উচিত হবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে না বলার মত অমানবিক হতে পারিনি আমি। বিদায় বেলাটা সেরকম নাটকীয় কিছু হয়নি। বাস ছেড়ে দিচ্ছিলো, তাই ব্যস্ততা ছিল। তাড়া থাকলে আসলে দুঃখ করার সময় থাকেনা, তাইতো আমরা প্রতিনিয়ত ব্যস্ততার অভিনয় করি, আমাদের দুঃখ গুলো ভুলে থাকার জন্য।

বাস এই মুহুর্তে আছে ফেরিতে। আর আমি পনের টাকার বেনসন অ্যান্ড হেজেস হাতে নিয়ে বসে আছি ফেরির ছাদে। আমার সামনে বসে আছে আপাত সুখী একটি পরিবার। কর্তা গিন্নী আর তাদের দুই ছেলেমেয়ে। বাচ্চা দুটোর হাতে মিস্টার টুইস্ট। আমিও এক সময় এভাবে বাবা-মা’র পাশে বসে থাকতাম। বাবার ভ্রু কুঞ্চিত থাকতো, যেন জীবনের কোন জটিল সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায় মগ্ন কোন প্রাচীন দার্শনিক। মায়ের হাতে থাকতো নানা রকম সামগ্রী- খাবার,পানি, চিপসের প্যাকেট, আধ খাওয়া আপেল, চিরুনী, আয়না ইত্যাদি নানা রকম ইহজাগতিক বস্তু। আমি হাতে চিপস বা চকলেটের প্যাকেট নিয়ে বসে বসে ভাবতাম, আমি সিন্দাবাদ হলে এই জাহাজটিকে ঠিক কিভাবে সাজানো যেত।

সেগুলো অবশ্য এখন সবই বিশুদ্ধ পাস্ট ইনডেফিনিট টেন্স। এসব ঘটনা ঘটার শেষ সম্ভাবনাটুকুও পাঁচ কিংবা ছয় বছর আগে শেষ হয়ে গেছে।

এখন মায়ের সাথে একসাথে বসে খেতে হলে, অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে, এগারো টাকার বেনসন পনের টাকা দিয়ে কিনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যেতে হয় দূরের কোন অপরিচিত শহরে। এছাড়া ‘তার’ সাথে দেখা হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই।

ফেরি ঘাটের কাছাকাছি এসে গেছে। আকাশে কালো মেঘ করেছে। হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠছে বিদ্যুতের শিখা। টিমটিম করে আলো জ্বলছে- নদীতে, আকাশে।

আকাশে মেঘ,তারা নেই। মনে শূন্যতা, তাড়া নেই। অন্ধকার আকাশ,আর বেগুনী জল ঐ দিগন্তে মিশমিশে কালো হয়ে মিশে গেছে। আর হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে উঠছে- পারলৌকিক ফ্ল্যাশলাইট। হঠাৎ এক বিন্দু তারা, মেঘ ফুঁড়ে বেড়িয়ে এলো, যেন নদীর বুকে ভেসে চলা কোন ঘুমন্ত মাঝির টিমটিমে আলো। বাবা বলতো, নদীর হাওয়া নাকি স্বাস্থ্যকর, খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে গোটা পদ্মাটাকেই। আমি বলি,এই হাওয়ায় আছে মাদকতা। নাহলে হাত মোজা পরা,নদীর মত কালো পোশাকে আবৃত নারীটি হঠাত গুণগুণিয়ে উঠবে কেন? না হলে অনিশ্চয়তার বুকে ভেসে চলা কুবের মাঝির কন্ঠে কেন বাজবে ভাটিয়ালি সুর? ও রাত জাগা নদীর পাখি, বলে দাও আমার গন্তব্য কত দূর? আর কত দূর?

মন্তব্যসমূহ