একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়



লেখকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। নামে চিনতাম তাকে। সামনাসামনি প্রথম দেখি 'ঢাকা লিটারেচার ফেস্ট' এ একটা আলোচনায়। লেখকের স্বাধীনতা বা এধরণের কোন আলোচনায় বক্তা হিসেবে এসেছিলেন। আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহ ছিল। যা শুনতে গিয়েছিলাম বা শুনতে চেয়েছিলাম- সেগুলোই বলছিলেন তিনি কিন্তু তাকে বলতে দেয়া হচ্ছিল সব থেকে কম। আয়োজকগণের অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয় কিনা! 

ঐ আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে আমার যে উপকারটা হল সেটা হচ্ছে আমি এই মানুষটি সম্পর্কে আগ্রহী হলাম। মানুষটির উপস্থিতি জানা ছিল কিন্তু লক্ষ করা হয়নি কখনো। ইন্টারনেট মাধ্যমে কিছু লেখা পাঠ করা হলেও বই পড়া হয়নি। এবার বইমেলা থেকে তাই এই বইটি হাতে তুলে নিলাম। ওখানে লেখকের গল্প উপন্যাসও ছিল। তারপরও এই বইটিই কেন? 

এই বই থেকেই উদ্ধৃত করি- 
"একেকটি বই হাতে নিয়ে আমারো মনে হতে থাকে, যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে শব্দ ও অক্ষরগুলো। প্রতিটি বই যেন সত্যিই একেকটা টেস্টামেন্ট, ঐশ্বরিক নয় বরং একজন  মানুষেরই লেখা এবং যার অনেকখানিই আত্মজৈবনি। যেন কথা বলছে এমন এক অস্তিত্ব সম্বন্ধে যা পৃথিবীর অন্য সব কিছুর চেয়ে জটিল, নিগূঢ় রহস্যময়, এবং নিবিড় প্রেমময়।" 

এই বইয়ের লেখা গুলো লেখকের একান্ত নিজস্ব কিছু ভাবনা এবং 'অনেকখানি আত্মজৈবনিক'। তাই মনে হল, এই বইয়ের লেখা গুলো যা আসলে গল্প নয় কিন্তু একদিন গল্প হয়ে যাবে- এই লেখা গুলোই ব্যক্তিটিকে বুঝতে সব থেকে বেশি সাহায্য করবে। 

প্রথম গল্প বা গল্প হয়ে যাওয়া লেখাটি পড়েই চমকে উঠি।  এ যেন আমারই ডায়েরির পাতা ছাপার অক্ষরে দেখতে পাচ্ছি। মিলে যাচ্ছে অনেক অভিজ্ঞতা। লিখতে চাওয়ার ইচ্ছা, পাঠকের আকুতি, মাথার উপর মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলে থাকার ভয়, গৃহবন্দী হয়ে থাকার তীব্র যন্ত্রণা, প্রিয়জন হারানোর শোক- এ তো সব আমারই কথা, আমারই প্রায় গল্প হয়ে যাওয়া কথামালা। 

লেখক বলছেন- "বয়স তো কেবল জন্মসাল দিয়ে মাপা যায় না, মাপতে হয় অভিজ্ঞতা দিয়ে। কোনো কোনো অভিজ্ঞতা মানুষের বয়স বাড়িয়ে দেয়। সবচেয়ে বেশি বাড়ায় আপনজনের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা। একেকটি মৃত্যুদৃশ্যের অভিজ্ঞতা হাজার বছর বয়সী। জীবন ও পৃথিবীকে দেখার ধাঁচ তৈরি করার ব্যাপারে এইসব অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।" 

কী অদ্ভুত সত্যি কথা! আমার থেকে ভালো আর কে জানে? লেখকের মায়ের গল্প, তার কৈশরের কথামালা আমার সাথে যেন মিলে যায় কোন ভাবে। আমি নিজেও আমার এসব গল্পের মত কথা গুলো 'উদ্বাস্তুর দিনলিপি' শিরোনামে লিখে রাখতাম, নিজের জন্য। এই বইটির লেখা গুলো পড়েও বুঝতে পারি, এই লেখা গুলো লেখকের নিজের জন্যই। লেখককে তাই আপন মনে হয়। 

প্রিয় Ahmad Mostofa Kamal, আপনার 'একদিন সব কিছু গল্প হয়ে যায়' পাঠের পর এক ধরণের বিষণ্ণতা মিশ্রিত ভালো লাগা কাজ করছে। কোন এক ঝড়ের রাতে আধশোয়া হয়ে নিজের জীবনের ফেলে আসা দিন গুলোর সুখ আর তীব্র বেদনার কথা ভাবলে যেমন অনুভূতি হয়, ঠিক তেমন একটা অনুভূতি। 

পার্থিব ও বৈষয়িক জীবনে সাফল্য লাভের পথে যাত্রা করলে অবধারিত ভাবে শৈল্পিক আর সংবেদনশীল জীবনের যে মৃত্যু ঘটে, আমার এখন নিজেকে সেই মৃত্যু পথের যাত্রী বলে মনে হয়। এক ধরণের দ্বন্দ্ব নিজের ভিতরে টের পাই, যার কোন সমাধান নেই। আপনার এই কথা গুলো আমার ভাবনাটাকে আরো উসকে দিল যেন- 

"মানুষ চিরকাল বিভ্রম নিয়ে বাঁচে যে, এই পৃথিবীতে তার অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব, অথচ সময় কত কম! এটা বিভ্রমই। বিশুদ্ধ বিভ্রম। হয়তো মধুর বিভ্রমও, নইলে মানুষ কী নিয়ে বাঁচতো?" অথচ এই বিভ্রমের পিছনে ছুটতে ছুটতেই তো সময় চলে যাচ্ছে।

 "শিল্প বোধহয় মানুষের চেয়ে সহৃদয়", আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই কথা গুলো আপনার মত, আমাকেও চমকে দেয়। সেই শিল্পকে আরাধনা করার সুযোগটুকু যেন পাই, সেটাই একমাত্র কামনা। আর আপনার লেখক জীবন সেই শিল্পের মতই সহৃদয়   হয়ে উঠুক... একদিন সব কিছু বিশুদ্ধ গল্প হয়ে যাক, টিকে থাকুক হাজার বছর।

মন্তব্যসমূহ