মুজিব শতবর্ষ স্মরণে

দেশের সকল ব্যাংকার দের BAB (BANGLADESH ASSOCIATION OF BANKS) এর পক্ষ থেকে মুজিব বর্ষ পালনের জন্য একটি করে টি-শার্ট আর প্ল্যাকার্ড  পাঠানো হয়েছে। সেই টিশার্ট পরে ১৮ মার্চ সকালে যার যার ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ১০ মিনিট ধরে প্ল্যাকার্ড নাড়াতে হবে! আর এই নাড়ানাড়ির, দোলাদুলির ছবি ভিডিও সংরক্ষণ করতে হবে। পুরো বিষয়টা আমার কাছে এক ধরণের জোকারি বা রসিকতা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। 

আমি শেখ মুজিবের আদর্শে বড় হওয়া লোক। ছোটবেলায় বুঝ হওয়ার পর বাসার দেয়ালে শেখ মুজিবের বিরাট ছবি দেখে বড় হতে হতে আমরা ধরেই নিতাম এই লোক আমাদের পরিবারেরই কেউ! তাঁকে কখনো 'শেখ মুজিব' বলে সম্বোধন করেনি আমাদের পরিবারের কেউ, 'বঙ্গবন্ধু'ই ছিল পরিচয়। আমি যখন ছোট, যখন বিএনপি জামাতের শাসন চলছে দেশে, তার আগে শাসন করে গেছে দুই সেনাশাসক, তখন ক্লাসের বই গুলোতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত। টিভি, সিনেমা, পত্রিকা কোথাও তাঁর নাম উচ্চারিত হত না, গাওয়া হত না কোন দেশাত্মবোধক গান। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন ১৫ আগস্টে ধুমধাম করে পালিত হত খালেদা জিয়ার বানোয়াট জন্মদিন। তখন রাষ্ট্রীয় ভাবে তাঁর নাম মুছে ফেলার যাবতীয় চেষ্টা চলমান ছিল। 

তখন তাঁর লেখা বই গুলোও প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু আমার সৌভাগ্য বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর উপর অজস্র বই বাবা কিনে রেখেছিলেন। দেখতাম নামাযের পর বাবা মোনাজাত ধরে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করছেন। গল্প শুনতাম এই মানুষটার। মনে হত আমারই পূর্বপুরুষ কেউ একজন। নিজে যখন পড়েছি তাঁকে নিয়ে তখন বিস্মিত হয়েছি আরো বেশি। আমি সেই আদর্শ ধারণ করা লোক। তাই 'মুজিব বর্ষ' পালনের নামে এসব জোকারি দেখলে নিজের কাছে খারাপ লাগে। 

মুজিব বর্ষ পালিত হতে পারতো মুজিবের আদর্শ গুলোকে চর্চা করার মধ্য দিয়ে, তাঁকে জানার মধ্য দিয়ে। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড নাড়ানোর মধ্যে এই আদর্শের পরিচয় রয়েছে কিনা সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। কারা যেন দেখলাম 'মুজিব ক্যালেন্ডার' নামে একটা অদ্ভুত জিনিস বের করেছে। এটা যদি এই দিনটি উপলক্ষে একটি 'স্মারক' হয়, তাহলেও মেনে নেয়া যায় কিন্তু এটাকে যদি কেউ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে দৈনন্দিন কাজে, তাহলে শেখ মুজিবের অপমান ছাড়া সেটা আর কিছুই না। 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলতে আমি কী বুঝি? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমাদের সংবিধানে খুব সুন্দর করে লেখা আছে- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র। মানুষের মুক্তি, বাঙালিত্বের চর্চা ও বিকাশ, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার- এগুলোর জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করেছেন, তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। এগুলোই মুজিবের আদর্শ। মুজিবের আদর্শ কোন ফাঁকা বুলি নয়। এই আদর্শের মধ্যে একই সাথে ফিলোসফিকাল এবং প্রাক্টিকাল চর্চার বিষয় আছে। প্রথমে সেই ফিলোসফি জানতে ও বুঝতে হবে এবং তারপর সেটা চর্চা করতে হবে। 

মুজিব বর্ষ পালন উপলক্ষে নানা রকম আয়োজন করা হয়েছিল। করোনা ভাইরাসের উপদ্রবে অনেক আয়োজন বাতিল করা হয়েছে, অনেক আয়োজন সীমিত করা হয়েছে। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই, সেখানে এই সীমিত আয়োজনও অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, এই বিশেষ দিনে পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমিত আকারে কিছু আয়োজন করা যেতেই পারে। কিন্তু আয়োজন গুলো যতটা না আদর্শিক, তার থেকে বেশি লোকদেখানো আচারসর্বস্ব। 

অন্যদের কথা বাদ দেই। BAB কী করতে পারতো? তারা যেহেতু সবাইকে একটা করে টিশার্ট পাঠিয়েছে, তারা নিশ্চয়ই সব ব্যাংকারদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক এগুলোর ব্যবস্থাও করতে পারে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকার ক্যাশ হ্যান্ডেল করে তারা মারাত্মক ঝুঁকির ভিতরে রয়েছে। এতো গেল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিষয়। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা তিনটি বই রয়েছে। সকল ব্যাংকারদের BAB কোন একটি বই উপহার হিসেবে দিতে পারতো, যা হতে পারতো মুজিব বর্ষ উপলক্ষে শ্রেষ্ঠ উপহার। অনেক ব্যাংকেই 'মুজিব কর্নার' স্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টা ছোট আকারে সকল ব্যাংকের, সকল ব্রাঞ্চে করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর নামে দেয়া যেতে পারে শিক্ষাবৃত্তি। 

কেক আমরা কাটছি ঠিক আছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত কেক কাটার সময় বঙ্গবন্ধুর ছবিটি কী করা হবে- সেটা আমার খুব দেখার ইচ্ছা! 

অথচ শেখ মুজিবের আদর্শ অনেক ভারী ব্যাপার। আপনাকে কাজ করতে হবে অন্য মানুষের মুক্তির জন্য, হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তরে লালন করতে হবে বাঙালিত্বকে, বিশ্বাস রাখতে হবে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রে। তবেই আপনি দাবী করতে পারেন আপনি মুজিবের আদর্শের সৈনিক। অন্যথায় সব কিছু স্রেফ লোক দেখানো ফাঁকা বুলি। 

শেখ মুজিবের সোনার বাংলা গড়তে তাঁর কন্যার একক লড়াইয়ে এসব লোক দেখানো কাজ কোন সাহায্যে আসবে না। অথচ তাঁর পাশে যদি থাকতে পারে সত্যিকারের মুজিবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষ গুলো, তাহলেই এই প্রক্রিয়া তরান্বিত হবে। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু  বলেছিলেন, "সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তাঁরা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তাঁরা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাঁদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।" কোন সরকারি কর্মচারী যদি আসলেই মুজিবের আদর্শ লালন করে থাকে, তার পক্ষে কোন অন্যায় বা নীতিবহির্ভূত কাজ করা সম্ভব নয়। 

কিছু প্রতীকী অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয়তো আছে। যে মানুষটি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত আরো একশ বছর, যে মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশেরই জন্ম হত না, সেই মানুষটির শততম জন্ম মুহুর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আলাদা কিছু করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে এগুলো যদি শুধু আচারসর্বস্ব হয়, তাহলে কোন লাভ তো নেই, উল্টো ক্ষতি। শেখ মুজিব জনতার নেতা ছিলেন, ছিলেন মাটির কাছাকাছি মানুষ। তাঁকে আকাশে তুলে সাধারণ মানুষের সাথে যদি দূরত্ব বাড়ানো হয়- তার ফলাফল সুখকর হবে না। সেই সাথে, পৃথিবী এখন একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এই বিপদের বাইরে নয়। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে, মুজিবের আদর্শ অনুসারে হলেও সব কিছুর আগে এই বিপদকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

যেহেতু একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, তাই টিশার্ট পরে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে যাব, কেক কাটবো- খাবো। কিন্তু এটা আমার মুজিব বর্ষ উদযাপন নয়। আমি শেখ মুজিবের ভাষণ, তাঁর লেখা স্টাডি করবো, সেগুলো নিয়ে লিখবো মানুষকে জানাতে। আমি মুজিবের আদর্শ অন্তরে লালন করবো। আমি শপথ করছি, আমি যেখানেই যাই, যে পেশাতেই থাকি- মানুষের মুক্তি, অসহায়ের পাশে থাকা, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা এবং বাঙালিত্বকে হৃদয়ে ধারণ করে কাজ করবো। আমার পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবো মুজিবের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা। এটাই আমার মুজিব বর্ষ পালনের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা।

মন্তব্যসমূহ