করোনা ও একদল অবিবেচক

দুটি ভাইরাস যদি একই সাথে কোন কোষকে আক্রমণ করে তাহলে জন্ম নিতে পারে নতুন একটি ভাইরাসের যার মধ্যে দুটি ভাইরাসের  কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে এবং যেটা হোস্টের আরো বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম । বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতায় আক্রান্ত। উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো তাদের উন্নত প্রযুক্তি আর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে কোন এক বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ নির্বিকার ভাবে চলাফেরা করছে। সরকারি অব্যবস্থাপনা আর উদাসীনতার সাথে এর পিছনে কাজ করছে আরেকটি কারণ- যেখানে দুটো ভাইরাস একই সাথে আক্রমণ করছে এই অঞ্চলের মানুষকে। দুটি ভাইরাসের যুগপৎ আক্রমণে তাই এই অঞ্চলের মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনে। একটি ভাইরাস বিকল করছে শ্বাসযন্ত্র কে, অন্যটি বিকল করছে আমাদের মস্তিষ্ক। ভাইরাস দুটির একটি করোনা ভাইরাস, অন্যটি হচ্ছে- বিশ্বাসের ভাইরাস। 

বিশ্বাসের ভাইরাস সম্পৃক্ত ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার সাথে। দু:সময়ে টিকে থাকতে হলে, স্থির থাকতে হলে এবং সাহস ধরে রাখতে হলে ধর্মীয় বিশ্বাসের দরকার আছে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস, প্রার্থনা অনেক মানুষের মন শান্ত রাখতে কিংবা মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে, সাহস যোগায়। কিন্তু যদি এই বিশ্বাস অসুস্থতার পর্যায়ে চলে যায়, যা ব্যাহত করে স্বাভাবিক কার্যক্রম, অস্বীকার করে বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টস সমূহকে তখনি তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

ক্যালিফোর্নিয়াতে এরকম একটি কেসের কথা জানা যায় যেখানে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান বাবা মা তাদের সন্তান অসুস্থ হলেও ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। তাদের বিশ্বাস ছিল প্রার্থনার মাধ্যমেই তারা তাদের সন্তানকে সুস্থ করে তুলতে পারবে, তাদের কোন চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই! বলাই বাহুল্য, কেবল মাত্র প্রার্থনায় কারো রোগ সেড়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। মেয়েটিও শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি, তার বাবা মায়ের সীমাহীন অজ্ঞতার কারণে। মেয়েটি কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল এই মুহুর্তে মনে নেই, তবে তার বাবা মা নি:সন্দেহে আক্রান্ত ছিল বিশ্বাসের ভাইরাসে। 

এটা যখন ব্যক্তি পর্যায়ে হয় তখন সর্বোচ্চ একটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যদি এটা জাতীয় পর্যায়ে অধিকাংশ মানুষের ভিতরে কাজ করে তবে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যারা বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত না, তারাও ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পায়না। কিছু মানুষের নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ পুরো দেশ, কখনো কখনো পুরো মানব সম্প্রদায়। যেটা এই মুহুর্তে ঘটছে আমাদের দেশে। 

প্রথম যখন করোনা ভাইরাস আক্রমণ করে চীনে তখন আমাদের দেশের অতি ধার্মিক জনতা ঘোষণা করলো- এটা হচ্ছে চীনের উপর আল্লাহর গজব! চীন উইঘুরে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করেছে দেখে আল্লাহ এই ভাইরাসের মাধ্যমে শাস্তি দিচ্ছে চীনকে। ধীরে ধীরে এই ভাইরাস গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। করোনাকে চীনের উপর আজাব ঘোষণাকারী এক ইরানি মুফতি এবার নিজেই আক্রান্ত হল করোনায়! 

এদেশের মানুষের অবশ্য তাতে কোন ভাবান্তর হল না, তারা বললো যেহেতু ইরানীরা শিয়া, এবং শিয়ারা 'সহীহ মুসলমান' না, তাই এই ভাইরাস ইরানে আক্রমণ করেছে।  কোন এক বিচিত্র কারণে, এই দেশের মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণা প্রবল হল যে- 'খাঁটি মুসলমান' দের এই ভাইরাস আক্রমণ করবে না! 

যদিও 'খাঁটি মুসলমান' বিষয়টা একটা আপেক্ষিক ধারণা। সুন্নীদের কাছে শিয়ারা খাঁটি নয়, শিয়াদের কাছে সুন্নীরা খাঁটি নয়। আবার আরবের মুসলিমরা এই উপমহাদেশের মুসলমানদের খাঁটি মুসলিম বলে মনে করে না। আইএস এর কাছে তারাই খাঁটি মুসলিম, আবার তালেবানরা আইএস দের খাঁটি মুসলিম মনে করে না! মজার বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতি- ঘুষ- অপরাধ- ভেজাল মেশানো- ধর্ষন- মুনাফাখোর ইত্যাদি নানা পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত বাংলাদেশীরা নিজেদের মনে করছে 'খাঁটি মুসলমান'!  

যেখানে করোনা থেকে বাঁচার সব থেকে ভালো উপায় হচ্ছে যথাসম্ভব স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী থাকা, সকলের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা সেখানে এদেশের মোল্লারা পঁচিশ হাজার মানুষ জড়ো করে 'খতমে শিফা' আয়োজন করেছে। এদেশে যারা ওয়াজ মাহফিল করে, লোক সমাগম না হলে তাদের ওয়াজ ব্যবসায় মন্দা পড়বে। ব্যবসায়ীক কারণে হোক আর বিশ্বাসের কারণে হোক, এদেশে রোগ ছড়িয়ে পড়ার পরও তারা হুংকার দিয়ে যাচ্ছে। কোন না কোন ভাবে তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস পাকাপোক্ত করছে যে- খাঁটি মুসলমানদের এই রোগ হবে না! যেহেতু এদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হিসেবে তাদের খাঁটিত্ব নিয়ে ভালোভাবেই জানে, তাই নিজেদের পাপ পঙ্কিলতা, চুরি  বাটপারির অপরাধে ভীত হয়ে, 'খাঁটি' হতে তারা আরো বেশি ভীড় করছে মসজিদে! 


যেখানে সৌদি আরবে দুটি মসজিদ বাদে সব মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, জুমার নামায বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যেখানে বাহরাইনে আযানের ভাষাই পাল্টে দিয়ে বলা হচ্ছে ঘরে বসে নামায আদায় করতে, সেখানে আমাদের দেশের মসজিদ গুলোতে জুম্মার নামাযে লোক সমাগম যেন আরো বেশি হল। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষণা দিয়েছে- সুন্নত ও নফল বাসায় পড়ে, ফরজ মসজিদে পড়তে! যেন করোনা ভাইরাসের সাথে তাদের চুক্তি হয়েছে ফরজ নামাযের সময় ভাইরাস আক্রমণ করবে না। 


ভারতেও বিশ্বাসের ভাইরাসের সংক্রমণ আছে ভালো ভাবেই। সেখানে এই ভাইরাসে আক্রান্তরা করোনা থেকে বাঁচতে গরুর হিসু পান করছে, গোবর মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে! যদিও তাদের সরকার এই মেথডে না গিয়ে করোনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে । কিন্তু আমাদের এখানে ঘটছে ভয়াবহ ঘটনা। 

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের মানুষ জনও বিশ্বাসের ভাইরাসে মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত। প্রথম থেকেই করোনা মোকাবিলায় সরকারের খামখেয়ালীপনা ছিল। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরেও ছিল না পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে মন্ত্রী ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের হাস্যকর সব বক্তব্য। 

"যে দেশের প্রধানমন্ত্রী ফজরের নামাজ পড়ে দিনের কাজ শুরু করেন, সে দেশে করোনাভাইরাস বড় আতঙ্ক হতে পারে না" - শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ বিষয়ক উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। 

"নির্বাচন স্থগিত করা যাবে না, আল্লাহর রহমতে করোনা চলে যাবে"- ইসি। 
"দেশের প্রত্যেক মসজিদে জুমার দিনে করোনাসহ সব বিপদ থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে"-  ধর্ম প্রতিমন্ত্রী 

যেখানে এই ভাইরাস সংক্রমণ রোধের একমাত্র কার্যকরী উপায় হচ্ছে জনসমাগম এড়িয়ে চলা, সেখানে দায়িত্বশীলদের এসব দায়িত্বহীন কথাবার্তা একদিকে যেমন সরকারের অজ্ঞতা প্রকাশ করছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে পরিচালিত করছে ভুল পথে। এসব কথাবার্তা হুজুরদের হুংকারকে বৈধতা দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ ধরেই নিচ্ছে খাঁটি মুসলিম হতে পারলে এই ভাইরাস ধরবে না, ভাইরাস ধরুক বা নাই ধরুক জুম্মার নামাযে যেতেই হবে। এমনকি যদি কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারাও যায়, তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ হুজুররা ফতোয়া দিয়েছে 'করোনায় মারা গেলে সেটা হবে শহীদি মৃত্যু'! যেহেতু শহীদের জন্য জান্নাতে উত্তম প্রতিদানের ব্যবস্থা আছে, কাজেই করোনায় মৃত্যু হলেও সমস্যা কী! 

অবশ্য এই চিত্র নতুন নয়। ইতিহাস বিখ্যাত প্লেগ মহামারীর সময়ও মোল্লারা একই আচরণ করেছিল। 

দুর্যোগের সময় সাহস ধরে রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।না হলে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়, পরিস্থিতির অবনতি হয়। অধিকাংশ মানুষের কাছে এখনো এই সাহস ধরে রাখার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে প্রার্থনা, স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, বিপদ মুক্তি চেয়ে স্রষ্টার আশ্রয় প্রার্থনা। আপনি প্রার্থনা করুন, বিপদ থেকে মুক্তি চান আপনার মনের শান্তির জন্য, সাথে সাথে আপনাকে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের দেয়া পরামর্শ মেনে চলতেই হবে সত্যিকার অর্থে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে। সেটা না হলে নিজের সাথে সাথে সবার জন্যই বিপদ ডেকে নিয়ে আসবেন আপনি। 

যখন সাধারণ মানুষ অবিবেচক আচরণ করে, পার্থিব সমস্যা সমাধানের জন্য আশ্রয় খোঁজে অপার্থিবে তখন সমস্যা ঘণীভূত হয়। কিন্তু যাদের সমস্যার সমাধানে কাজ করার কথা, এমন লোকজন যখন অবিবেচক হয়, নির্ভর করে থাকে দৈব শক্তির উপরে- তখন সৃষ্টি হয় বিপর্যয়ের। আমরা সেই বিপর্যয়ের দিকে যাত্রা করছি কি না, কে বলতে পারে। 

কোন দৈব শক্তি বলে নয়, কোন বিজ্ঞানাগারের বিজ্ঞানীদের পরিশ্রমেই করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে। কোন মোল্লা, পুরোহিত বা ফাদারের প্রার্থনার কারণে নয়; বিশ্বজুড়ে লড়াই করে যাওয়া চিকিৎসক ও নার্সদের কল্যাণেই অধিকাংশ  করোনা আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা প্রার্থনা করবো, একই সাথে চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলবো। যেখানে সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে দুর্যোগ বা মহামারীর সময় জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, সেখানে অন্য কোন মোল্লার কথার কোন গুরুত্ব নেই। এই সাধারণ ব্যাপারটুকু বুঝলেই এই বিপদ থেকে অনেকটা নিরাপদ থাকা সম্ভব। 

করোনা থেকে হয়তো আমরা মুক্তি পাবো কিছু মানুষের কষ্ট, কিছু মৃত্যু আর চিকিৎসকদের ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কবে? 





মন্তব্যসমূহ