সেক্স এডুকেশন



ইংলিশ মিডিয়ামের সিলেবাসে 'গ্রোয়িং আপ' বলে একটা টপিক আছে যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের বয়সের উপযোগী করে 'সেক্স এডুকেশন' বিষয়টা পড়ানো হয়। মূলধারার বাংলা মাধ্যমে 'শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য' বিষয়টিতে বয়ঃসন্ধিকাল, শারীরিক পরিবর্তন, এইডস- এগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়া হয়েছে কিন্তু সেই অর্থে 'সেক্স এডুকেশন' বলতে যা বুঝায় সেটি এখানে সেভাবে নেই। অষ্টম শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষা বই-এ 'আমাদের জীবনে প্রজনন স্বাস্থ্য' নামক অধ্যায়ে গর্ভধারণ কী,অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি কী কী এবং অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ বন্ধ করতে সচেতন হতে হবে- এই ধরণের কিছু বিষয় ছাড়া আর কিছু নেই। নবম-দশম শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষা বই-এ 'বয়ঃসন্ধিকাল ও প্রজনন স্বাস্থ্য' নামক অধ্যায়টিতে বয়ঃসন্ধিকালে কী কী শারীরিক পরিবর্তন হয়, এসময় কী কী খাবার-দাবার খেতে হবে এসব দায়সারা ভাবে উল্লেখ করেই খালাস। অধ্যায়টি পড়লে একটি ছেলে বা মেয়ে কিছুতো জানবেই না বরং অর্ধেক তথ্য পেয়ে আরও বিভ্রান্ত হতে পারে। 

যেমন ঋতুস্রাব সম্পর্কে এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে- "এ সময় কিশোরীদের ঋতুস্রাব শুরু হয়। সবার ক্ষেত্রে শারীরিক পরিবর্তন গুলো একই সময়ে ও একই সাথে নাও হতে পারে। যেমন কিশোরীদের ক্ষেত্রে কারও আগে বা পরে ঋতুস্রাব শুরু হতে পারে।" কিন্তু এখানে বলা নেই কেন ঋতুস্রাব হয়, এর বায়োলজিকাল কারণটা কী, কেন কারও আগে বা কারও পরে হতে পারে ইত্যাদি আরও অনেক প্রশ্ন। এই বিষয় গুলো বৈজ্ঞানিক ভাবে আলোচনা না করে পরামর্শ দেয়া হয়েছে- "নির্ভরযোগ্য অভিভাবকদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করে জেনে নেয়া যেতে পারে।" কিন্তু যে মেয়েটির 'নির্ভরযোগ্য অভিভাবক' নেই? অন্য কারও থেকে জানতে হলে বই-এ এসম্পর্কে কিছু লেখারই তো দরকার নেই। আর এই বিষয় গুলোতো কেবল মেয়েদের নয়,ছেলেদেরও জানা উচিত।যেন তারা বিষয়গুলোকে বাঁকা চোখে না দেখে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে। 

একজন কিশোর বা কিশোরীর সামনে যখন প্রাকৃতিক ভাবে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিবর্তনের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা থাকবেনা তখন সে অন্যান্য মাধ্যমের দিকে ধাবিত হবে। সেই অর্থে শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বই গুলোতে 'সেক্স এডুকেশন' বলতে কিছু নেই,যা থেকে এই বয়সের একটি কিশোর বা কিশোরী অতিসাধারণ বিষয় গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বৈজ্ঞানিক ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে এই বয়সের অদম্য কৌতূহল তাকে বিভিন্ন বিকৃত মাধ্যমের দিকে ধাবিত করে। পর্ণ,চটি ইত্যাদি বিকৃত মাধ্যম থেকে বিকৃত ও ভুল যৌনশিক্ষা লাভ করে সে। বিশেষ করে, এই বিকৃত মাধ্যম গুলো ছেলেদের মন মানসিকতা বিষিয়ে দেয়। পর্ন ও চটি গল্প থেকে যে যৌনশিক্ষা লাভ করবে তার মধ্যে আপনাআপনিই ধর্ষক প্রবৃত্তি তৈরি হবে। এই সকল বিকৃত মাধ্যম থেকে সে শিখবে নারীরা সেক্স করার জন্য মুখিয়ে থাকে,যেকোন মেয়েকে একটু পটালেই সহজেই তার যৌন সম্পর্ক করা যায়, ধর্ষন কালে মেয়েটি আসলে আনন্দ পায়, শিক্ষিকা-ভাবী-খালা এমনকি মা-বোন- যেকারও সাথেই যৌন সম্পর্ক করা যায়। সেখানে সম্পর্ক কোন ব্যাপার না,সেখানে পোশাক কোন ব্যাপার না। আমরা সত্যিকারের বয়সভিত্তিক বৈজ্ঞানিক যৌন শিক্ষাকে ট্যাবু করে রেখেছি,আমাদের কিশোর কিশোরীরা (বিশেষ করে কিশোররা) তখন ধাবিত হচ্ছে এসব বিকৃত মাধ্যমের দিকে,এবং এগুলোকেই তারা সত্যি ভাবছে! 

সত্যিকারের যৌনশিক্ষা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, এই বিষয় গুলো ট্যাবু নয়। প্রতিটি মানুষ তার জীবনে এই স্তরের মধ্য দিয়ে যায়,তাই এই সময়ে সে যদি সঠিক শিক্ষা না পায় তাহলে বিপথগামী হওয়া বিচিত্র নয়,আর সেটাই ঘটছে আমাদের দেশে। আবার শুধু পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্তি করাও যথেষ্ট নয়। শিক্ষকদেরকেও পড়ানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি যখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি তখন এইডস নিয়ে আমাদের একটি অধ্যায় ছিল। যিনি আমাদের পড়াতেন তিনি এই অধ্যায়টি পড়াতেই বিব্রতবোধ করেছিলেন এবং আমাদের বলেছিলেন 'বাসায় নিজেরা পড়ে নিও'। আমাদের ক্লাসের ছেলেরা সেসময় 'সেক্স', 'অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক', 'কনডম', 'বীর্য' ইত্যাদি শব্দগুলো শুনলে মুখ চেপে হাসত,মনে করতো ভয়াবহ কোন শব্দ শুনে ফেলেছে! এর জন্য আমাদের শিক্ষকরাই দায়ী ছিলেন অবশ্য। তারা আমাদেরকে শেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে এই শব্দ গুলো কোন 'ভয়ানক' শব্দ নয়। প্রতিটি মানুষ এগুলোর সাথে সম্পর্কিত,এবং একারণেই সবার এগুলো সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানা উচিত। 

আমাদের একজন ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। তিনি আবার এই সব লজ্জার ধার ধারতেন না। তবে তিনি ছিলেন আরও এক ডিগ্রী উপরে। ইংরেজি পড়ানোর থেকে 'ধর্ম' পড়ানোর দিকেই তার আগ্রহ বেশি ছিল। তিনি ইংরেজি পড়াতে গিয়ে আমাদেরকে - ছেলেদের গলার স্বরতন্ত্রী (অ্যাডাম'স অ্যাপেল) এবং মেয়েদের স্তন  স্ফীত হওয়ার 'ধর্মীয়' ব্যাখ্যা শুনিয়েছিলেন! এই শিক্ষক অবশ্য পরীক্ষার আগে সাজেশনের নামে পুরো প্রশ্নপত্র তার কাছে 'প্রাইভেট' পড়া ছাত্রদের দিয়ে দিতেন,তাতে তার ধর্মবোধের কোন সমস্যা হতনা! 

যাইহোক, ধর্ষন- ইভটিজিং এগুলোর সাথে সরাসরি পর্ন দেখার সম্পর্ক আছে। যৌন শিক্ষা চালু করলে যে পর্ন দেখা বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা নয়,তবে তারা অন্তত ওগুলো থেকে 'শিক্ষা গ্রহন' করতে যাবেনা। sex education সর্বপ্রথম চালু হয় নর্থ আমেরিকার শিক্ষাক্রমে। বর্তমানে UNFPA সেক্স এডুকেশনকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। United Nations Social and Economic Commission for Asia এর তথ্য মতে  এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ,মায়ানমার,নেপাল ও পাকিস্তান ব্যতীত সব দেশেই মূল কারিকুলামে সেক্স এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত আছে। সেক্স এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের ছেলেমেদের সঠিক ভাবে শিক্ষিত করতে না পারলে, দেশটা যেভাবে ধর্ষকের আবাসস্থলে পরিণত হচ্ছে সেটি আরও ভয়াবহ রূপ পেতে বেশিদিন সময় লাগবেনা। 

আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি যে আমার এই কথা গুলো অরণ্যে রোদন মাত্র। আর আমাদের সরকারও পাঠ্য পুস্তকে সেক্স এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করবে - এতটা আশাবাদী আমি নই। উল্টো যা ছিল সেগুলো বাতিল করে দেয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। তবে ইন্টারনেটের এই যুগে চাইলে যেকোন বিষয়ে জানা যায়,শুধু থাকতে হয় আগ্রহ।  http://sexetc.org/ - এই সাইটটি একটি চমৎকার সেক্স এডুকেশনাল সাইট। এছাড়াও অনলাইনে আরও অনেক জার্নাল ,সাইট রয়েছে। সিদ্ধান্ত আমাদের- আমরা ইন্টারনেটে পর্ন সাইটে যাব, নাকি এগুলোতে?মনে রাখতে সত্যিকারের বিজ্ঞানভিত্তিক যৌনশিক্ষা নারীদের প্রতি সহিংসতা কমাতে অনেকাংশে সাহায্য করবে।

মন্তব্যসমূহ