করোনা এবং মরলকদের কথা

এইচ.জি.ওয়েলস এর 'টাইম মেশিন' উপন্যাসে লেখক টাইম ট্রাভেলারের মাধ্যমে বিভিন্ন সম্ভাব্য ভবিষ্যতের কল্পিত চিত্র একেছিলেন। সেখানে আমরা দেখতে পাই ভবিষ্যতে মানুষ প্রজাতির বিবর্তন দুটি আলাদা দিকে চলে গেছে। তথাকথিত সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী থাকছে সাজানো বাগানে, কোন রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না বলে তারা পরিণত হয়েছে এক ধরণের নির্বোধ সুখী প্রজাতিতে, বইয়ে যাদের বলা হয়েছে 'ইলয়'। অন্যদিকে মানুষের অন্য প্রজাতিটি থাকে মাটির তলায় গুহার ভিতরে- 'মরলক', যারা কিনা হিংস্র ও বর্বর, এরা মারামারি করে খাদ্যের জন্য, আলো সেখানে অনুপস্থিত। বলাই বাহুল্য, ওয়েলস 'ইলয়' দিয়ে সমাজের ধনীক শ্রেণী এবং 'মরলক' এর মাধ্যমে দরিদ্রদের বুঝিয়েছেন। 

ওয়েলসের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এই লেখায় তাকে সাহায্য করেছে। তিনি ছোটবেলায় দেখতেন বাড়ির কাজের লোকেরা থাকছে বেসমেন্টের অন্ধকার ঘরে, দেখেছেন কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের অন্ধকার অস্বাস্থ্যকর ঘুপচি ঘর। সেখান থেকেই তিনি মূলত এই আইডিয়াটা নিয়েছিলেন। 

টাইম ট্রাভেলের কথা থাকুক, ফিরে আসি বর্তমানে। ধনী ও গরিবরা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি প্রজাতিতে হয়তো  পরিবর্তীত হবে না, অত্যন্ত বায়োলজিক্যালি। কিন্তু প্রজাতির ধারণাটা আমরা যদি সামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি তাহলে দেখা যাবে- ধনী ও দরিদ্রের খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, ইকো সিস্টেম সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে! এমনকি আলাদা প্রজাতি হবার সব থেকে বড় যে শর্ত- পারস্পারিক যৌন প্রজননে অসমর্থ হওয়া বা উর্বর সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়া - সেটা ধনী ও গরিবের মধ্যে বায়োলজিক্যালি অসম্ভব না হলেও কালচারালি 'প্রায়' অসম্ভব! (অর্থাৎ ধনী ও গরিবের মধ্যে সামাজিক ভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক অস্বীকার করা!) কাজেই সামাজিক ভাবে ওয়েলসের কল্পিত ভবিষ্যতের দিকে আমরা যাত্রা করছি- এটা ভাবাটা খুব বেশি উর্বর কল্পনা হবে না। 

যদিও বিষয়টা এত সরল নয়। ক্লাস কনফ্লিক্ট নামে কিংবা বেনামে মানব সমাজের শুরু থেকেই বিদ্যমান ছিল। আধুনিক সমাজ, আধুনিক সভ্যতা মানুষের জীবন মানের উন্নতি করলেও এই বিভাজন দূর করতে পারেনি (পারবে বলেও মনে হয় না)। 'হয়তো' একটা সময় পৃথিবীর সব মানুষ দুবেলা খেতে পারবে,  সবার জন্য নিশ্চিত হবে বেসিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু তারপরেও থেকে যাবে শ্রেণী বিভাজন। 

যে কারণে ওয়েলস সাহেবকে টেনে আনা। একটা ভিডিও দেখলাম, কোথাও ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। মানুষের তুলনায় সেই ত্রাণের বস্তা অপর্যাপ্ত। যারা এসব কাজকর্ম করেন, তারা জানেন যে-  ত্রাণ কখনোই পর্যাপ্ত হবে না- আপনি ১০০ বস্তা আনেন বা ১০০০, সেটা কখনোই পর্যাপ্ত নয়। এখানেও তাই হল। কিন্তু এর পরের চিত্রটি ভয়ংকর। যেন 'টাইম মেশিন' থেকে উঠে আসা মরলকরা কিংবা প্যারাসাইট চলচ্চিত্রের বেসমেন্টে আশ্রয় নেয়া দুই পরিবার! ত্রাণ নিতে আসা মানুষ গুলো এই বস্তা নিয়ে একে অপরের সাথে মারামারি করছে। খোঁড়া ভিখারি মারামারি করছে কানা ভিখারির সাথে, বয়স্ক জন কাড়াকাড়ি করছে বাচ্চাকোলে থাকা কোন অল্পবয়স্কার সাথে। বস্তা নিয়ে হাতাহাতি করছে দুজন মহিলা। একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে, ছিড়ে যাচ্ছে বস্তা, রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে মহামূল্যবান ত্রাণ, সেগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে বড়দের সাথে সুবিধা করতে না পারা পথশিশুর দল। 

বাংলার মানুষ (ক্ষেত্র বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষ) ফ্রিতে দিলে আলকাতরা নিতেও মারামারি করে- এটা সত্য। তবে এই করোনা কালে, এর থেকেও বড় কোন এক 'সত্য' এই ডিস্টোপিয়ান মারামারিকে বিশুদ্ধ করুণ রুপে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। 

এখনো মৃত আত্মার কান্না শুরুই হয়নি। এখনো নেমে আসেনি অর্থনৈতিক মন্দার কালো পর্দা। পর্দার কিনারা দেখা মাত্রই আমাদের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। যখন রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে, একেএকে বন্ধ হয়ে যাবে হাসপাতাল গুলো, শেষ সময়ে পাওয়া যাবে না প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ, ক্ষুধাতুর মানুষ গুলো মরলক হয়ে আক্রমণ করতে আসবে আপনার প্রাসাদে, নেমে আসবে অন্ধকার- তখন কী করবো আমরা? 

আমাদের কি অযথা ভয় দেখানো হচ্ছে? আমরা কি ভয় পাচ্ছি অকারণে? হয়তো। সারা বিশ্ব যেখানে স্থবির, সেখানে নিতান্ত গুরুত্বহীন একটি ছোট দেশ হয়ে আমরা উৎরে যাবো- এমন আশা দুরাশা। তবে যদি দেখা যেত আমাদের মাঝিমাল্লারা প্রস্তুত, শক্ত হাতে তারা ধরে রেখেছে হাল- তাহলে হয়তো ভয়ংকর ঝড়ের ভিতরেও আশা রাখা যেত, বিশ্বাস করা যেত অলৌকিকে। কিন্তু আমাদের মাঝিদের অপ্রস্তুত অবস্থা ঝড়ের আগেই ডুবে মরার ভয়ে আমাদের কাবু করে, অস্থির করে। 

ঝড় শেষ হবে, সমুদ্র শান্ত হবে। নৌকা উল্টে গেলেও কিছু মানুষ ভাঙা টুকরো ধরে টিকে থাকবে। জীবন থেমে থাকবে না। বদলে যাবে অনেক কিছু। কিন্তু ধ্রুব থাকবে মানুষের ক্ষুধা আর ক্ষুধার জন্য লড়াই। 

আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ । এই মুহুর্তে দীর্ঘ সময় একই মানুষের সাথে, একই পরিবেশে, বদ্ধ স্থানে থাকতে থাকতে মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই। সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে শারীরিক ক্ষতের মত এবং পরিচর্যা করতে হবে। দু:সময়ে শারীরিক আঘাতের মত মানসিক নানা আঘাতও সহ্য করে যেতে হয়- টিকে থাকার জন্য। 

ঘরে থেকে মনকে আরামে রাখাটাই এখন আমার আপনার একমাত্র কাজ। যদি এই কথা গুলো পড়ার মত অখণ্ড অবসর আপনার থেকে থাকে- তবে ভয় নেই, আপনি মরলক নন। বেঁচে থাকলে টিকে যাবেন এ যাত্রায়।

মন্তব্যসমূহ