ধর্ম ও বিজ্ঞান

রিচার্ড হলোওয়ের 'ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' (অনুবাদ- কাজী মাহবুব হাসান) পড়ছিলাম। সেখানে জাপানের শিন্টো ধর্মে তাদের নিজস্ব সৃষ্টিতত্ত্বের আলোচনাটি পড়তে গিয়ে একটা কথা বেশ চমৎকার লাগলো-

"বিজ্ঞান বাস্তব তথ্য বা ফ্যাক্ট নিয়ে আগ্রহী, যেভাবে কোনোকিছু কাজ করে। শিল্পকলার আগ্রহ হচ্ছে নিজেদের জীবনে সেই সত্যটাকে আমাদের কাছে অনাবৃত করে তোলা। আর সে কারণে কাহিনী আপনাকে কাঁদাতে পারে, যখন আপনি এটিকে নিজের অভিজ্ঞতার সমরূপ হিসাবে শনাক্ত করতে পারবেন: এটাই তো আমি! ধর্ম একটি শিল্পকলা, এটি বিজ্ঞান নয়।

সুতরাং কোনো সৃষ্টিপুরাণ সত্য বা মিথ্যা কিনা, সেই প্রশ্নটি করা উচিত নয়, বরং যে প্রশ্নটি করতে হবে, সেটি হচ্ছে এটি আসলে কী বোঝাতে চাইছে, এটি আমাদের কী বলতে চাইছে। এই বিভাজনটি বহু ধর্মীয় মানুষই পুরোপুরি কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না। এবং তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে নির্বোধ হিসেবে উপস্থাপন করেন, যখন তারা বাইবেলের বর্ণিত সৃষ্টিকাহিনী শিল্পকলার কাজ নয়, বরং বিজ্ঞানের একটি কাজ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।" 

রিচার্ড হলোওয়ে নিজে খ্রিস্টান পাদ্রি ছিলেন, তাই তিনি বাইবেলের উদাহরণ দিয়েছেন। তবে আমরা জানি, সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। আর ধর্মকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করতে চাওয়ার এই চেষ্টা নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি করেছে আধুনিক কালে। এই প্রচেষ্টাটি কিন্তু বর্তমান কালের ঘটনা। এর কারণ গুলো নেড়েচেড়ে দেখা উচিত। 

ধর্ম কিন্তু কখনোই এর অনুসারী দের নিকট 'যুক্তি' দাবী করেনি। দাবী করেছে 'বিশ্বাস' এবং 'আনুগত্য'। যেটা যুক্তি দিয়ে বিচার্য সেটার প্রতি বিশ্বাস বা আনুগত্য আনতে হয় না। ইসলাম শব্দের অর্থই কিন্তু 'আনুগত্য',  যুক্তিবোধ নয়। ধর্ম গুলো কখনো বলেনি আমাকে যুক্তি দিয়ে বিচার কর, বরং কতগুলো দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছে, এগুলোর প্রতি প্রশ্নহীন বিশ্বাস স্থাপন কর। প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, সন্দেহ পোষণ করাকে চিহ্নিত করা হয়েছে পাপ হিসেবে। তাহলে কেন ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারীরা তাদের ধর্মকে 'বিজ্ঞানময়' হিসেবে প্রমাণ করতে এত মরিয়া? 

একটা সময় পর্যন্ত এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠেনি। কেননা ধর্ম ছিল স্পিরিচুয়াল জায়গা আর বিজ্ঞান প্রায়োগিক। কিন্তু আমরা জানি, আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ, যুক্তিবোধের যুগ। এখানে সব কিছু আধুনিক মানুষ যুক্তি দিয়ে বিচার করে। ধর্মীয় আইডিয়া গুলো টিকে থাকার জন্য সত্যিকারের অণুজীবের মত মিউটেশনের ভিতর দিয়ে যায়, নিজেদের পরিবর্তন করে। বর্তমান যুগের এই যুক্তিবাদ বা বিজ্ঞানমনস্কতা ধর্ম গুলোর জন্য হুমকি স্বরূপ ছিল। বিশেষ করে সেই ধর্ম গুলোর জন্য, যারা আধ্যাত্মিকার থেকে দৈনন্দিন জীবনের প্রায়োগিক নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। কীভাবে টয়লেট করতে হবে থেকে শুরু করে, কীভাবে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করতে হবে - সব কিছুই যেসব ধর্মের অন্তর্ভুক্ত- তাদের জন্য এই যুক্তিবাদ সমস্যা সৃষ্টি করলো। 

বর্তমানে যে জিনিসটির উপর সব মানুষের আস্থা আছে, সেটি হল- বিজ্ঞান। তাই এসব ধর্মের অনুসারীরা তাদের সকল ধর্মীয় কার্যকলাপকে বিজ্ঞানসম্মত হিসেবে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগলো। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারকে তারা নিজেদের ধর্মগ্রন্থে খুঁজে বের করতে শুরু করলো! বিগব্যাং থেকে শুরু করে চাঁদে মানুষ যাওয়া- সব কিছুই নাকি ধর্মগ্রন্থে আগে থেকেই বলা আছে! বিভিন্ন অস্পষ্ট কথামালাকে যেভাবেই হোক কোন ঘটনার সাথে মিলিয়ে দিয়ে এটিকে বিজ্ঞানময় হিসেবে প্রমাণ করতে থাকলো।

বিজ্ঞান যেমন অতীত ঘেটে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের দিকে আলোকপাত করে, ধর্ম গুলোও একই চেষ্টা করতে থাকে। কেন? কারণ তারা জানে আধুনিক যুগে যা বিজ্ঞানসম্মত নয় বা যুক্তির বাইরে- সেগুলোর অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন।  অথচ এই চিন্তা আসারই কথা না যদি ধর্মকে দেখা হয় স্পিরিচুয়াল দৃষ্টিকোণ থেকে। 

যেমনটা বলেছেন হলোওয়ে- ধর্ম বিজ্ঞান নয়, শিল্পকলা। আর শিল্পকলা যুক্তি নিয়ে কাজ করে না, কাজ করে অনুভূতি নিয়ে। শিল্পকলা আমাদের মনের খোড়াক যোগায়, আমাদের চিন্তাকে আলোড়িত করে। ধর্ম বা ধর্মীয় কাহিনী গুলোর উদ্দেশ্যও তাই। ইসলাম ধর্মে সুফি সাধকরা এই বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন সব থেকে ভালো ভাবে। তাই তাদের ধর্মচর্চা হয়ে উঠেছিল শিল্প। সেখানে স্রষ্টার প্রতি ছিল ভালোবাসা, ভয় নয়। স্রষ্টা সেখানে দূরবর্তী কোন কিছু নয়, বরং অন্তরে বাস করা কোন শান্তিময় ব্যাপার। 

কিন্তু ধর্মের আক্ষরিক অনুসরণ যারা করে তারা শিকার হয় এই সংকটের। ধর্মকে অস্বীকার করতে পারে না তারা, আবার জানে বিজ্ঞান বাদে তারা অচল। তাই বিজ্ঞান দিয়ে 'তার নিজের ধর্মই শ্রেষ্ঠ' প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। মরীয়া হয়ে চেষ্টা করে সহস্র বছরের পুরানো কোন জীবনধারা বা আচার পালন করতে যা হুমকীতে ফেলতে পারে তার বর্তমান কে। যেমনটা আমরা দেখছি এখন, এই করোনা দুর্যোগে। 

জনসমাগম যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে তারা ধর্মের জন্য অমান্য করছে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানকে আর বিপন্ন করছে নিজেদের ও অন্যদের জীবন। মুসলিম মোল্লা, হিন্দু পুণ্যার্থি, ইহুদি রাবাই, চার্চে ভীড় করা খ্রিস্টান - সবাই এই কাজটি করছে। আধুনিক যুগে ধর্মের এই আক্ষরিক প্রয়োগ কীভাবে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি সারা বিশ্বেই। 

ধর্মকে যদি আমরা দেখি শিল্প হিসেবে, নিজেদের আত্মার শান্তির জন্য, আর দৈনন্দিন জীবন যাপনে যদি আমরা অনুসরণ করি বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা- একমাত্র তাহলেই একটি সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব। যদি সেটা করতে ব্যর্থ হই আমরা, যেমনটা হচ্ছি প্রায় সবাই, তাহলে দুর্যোগকালীন সময়ে কষ্টের সীমা থাকবে না। 

অযথা নির্বোধের মত ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। ধর্মগ্রন্থে সব বলা আছে, তার মানে এই নয় যে আপনি কোন রোগে কোন ওষুধ খাবেন সেটাও সেখানে বলা আছে। বরং এর মানে হচ্ছে, জীবন চলার পথে যে সাধারণ মানবিক শিক্ষা গুলো প্রয়োজন- সেগুলো বলার চেষ্টা করছে ধর্মগ্রন্থ গুলো। সেটাকে শিল্পের মত অন্তরে ধারণ করতে হবে, বিজ্ঞানের মত প্রায়োগিক ভাবে নয়। কুরানে তো বলাই আছে, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য আছে সুস্পষ্ট নিদর্শন!

মন্তব্যসমূহ