কেয়ামতের কিছুক্ষণ আগে

১.
"কিয়ামত সংঘটিত হবে না যে পর্যন্ত এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, পৃথিবীতে 'আল্লাহ আল্লাহ' বলার মত কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।" 
-তিরমিযি 

২.
আমি প্রাণপণে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকি। আমার গলা ভেদ করে সেটা ঠিক মত শোনা যায় না, কেমন যেন ফ্যাশফ্যাশে এক ধরণের আওয়াজ বের হয়। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন আমার ডাকটা আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। আচ্ছা আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, তিনি জানেন মাটির তলায় বিচরণ করা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকামাকড়ের কথাও। তবে কি তিনি আমার কথা শুনতে পাবেন না? আমার শ্বাসযন্ত্র বিদীর্ণ করে আসা কিছু দুর্বোধ্য আওয়াজের মর্মোদ্ধার কি তিনি করতে পারবেন না? 

আমি সম্ভবত এই পৃথিবীর সর্বশেষ জীবিত ব্যক্তি। অন্তত আমার নিজের কাছে তাই মনে হচ্ছে। আমি মানুষ দেখি না বহুদিন হয়। এই অন্ধকার ঘরটিতে কোন রকমে কীভাবে টিকে আছি, সেই রহস্য আমি উদঘাটন করতে পারি না। আমি বুঝতে পারছি কেয়ামত আসন্ন। আমি তাই সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহকে ডাকছি যেন ঈস্রাফিল তার মহাশক্তিধর শিঙ্গায় ফু দিতে কিছুক্ষণ দেরি করে। 

আমার প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। ক্ষুধাও কি লেগেছে? হয়তো। কিন্তু টের পাচ্ছি না। এই মুহুর্তে পানি খাওয়ার মত শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই আমার। আমি জানালার ওপাশে দেখতে পাচ্ছি দেবদূতদের। আচ্ছা, দেবদূতদের কি ঘ্রাণ শক্তি আছে? তারা কি লাশের গন্ধ পায়? 

দেবদূতরা আমাকে নিতে এসেছে হয়তো। কিন্তু আমি চলে গেলে কি ধ্বংস হয়ে যাবে এই পৃথিবী? এই পৃথিবীর আর কোন কিনারে, কোন পরিত্যক্ত ঘরে, কোথাও কি আছে আর এমন কেউ- যে আল্লাহ কে ডাকছে? যদি না থাকে তবে আমার সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে এই বহু যত্নে গড়ে তোলা পৃথিবীটা। 

আমার শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতি মুহুর্তে বাড়ছে এই কষ্টটা। মরে যাওয়ার আগে অন্তত একবার আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে চাই। অন্তত একবার চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চাই নাক দিয়ে বাতাস টেনে নেবার আনন্দটুকু। আমাকে কি সেই সুযোগ দেয়া হবে? 

এই মুহুর্তে একজন মানুষের হাতের স্পর্শ পেতে খুব ইচ্ছা করছে। খোদা যদি আমাকে জান্নাতে স্থান দেয় তবে আমি সবার আগে সেই মানুষটির স্পর্শ পেতে চাইবো। শহীদি মৃত্যুর বদৌলতে এটুকু তো আমি চাইতেই পারি। আচ্ছা মহামারীতে মরলে কেন সেটা শহীদি মৃত্যু হয়? এটা কি স্রষ্টার তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ? 

সেই মানুষটি নেই। সে পাশের ঘরে পড়ে আছে। খুব সম্ভবত গত রাতে কোন এক সময় তার মৃত্যু হয়েছে। রোগে না ক্ষুধায় - সেটা আমি নিশ্চিত নই। এখনো পচন ধরেনি লাশে। কিংবা হয়তো ধরেছে, আমি গন্ধ পাচ্ছি না। আচ্ছা ফেরেশতারা কি পায় মৃতের গন্ধ?  

আমার সাথে সাথেই যদি শেষ হয়ে যায় এই পৃথিবী তাহলে লাশের পচন নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু এই পৃথিবীর কোন প্রান্তে যদি একজনও থাকে আল্লাহ কে ডাকার জন্য তবে হয়তো আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমার মনে হয় না, আর কেউ অবশিষ্ট আছে। অন্তত স্রষ্টাকে স্মরণ করার মত। যদি থাকতো, তাহলে আল্লাহ আমাদের ডাক নিশ্চয়ই শুনতেন। 

তিনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমার দুর্বোধ্য আহবান। হে আল্লাহ, আমাকে একটি বার পূর্ণ ভাবে শ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দাও। 

আল্লাহ আল্লাহ। আমার শ্বাস চেপে ধরে আছে কেউ একজন। কে সে? অন্য কোন মানুষ? দেবদূত?  ফেরেশতা? না শয়তান? আযরাইল? 

তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে কেবলি অন্ধকার। 

৩.
পৃথিবীর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে।  বিভিন্ন ঘরবাড়ি থেকে বেঁচে থাকা মানুষেরা আরো অসংখ্য মৃত মানুষের গলিত-অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় লাশ গুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। পৃথিবী তাদের মনে রাখে, ইসরাফিলের শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার আগ পর্যন্ত। 



মন্তব্যসমূহ