বিথোভেনের গিটার

জরুরী অবস্থা তুলে নেয়া হয়েছে আজ দ্বিতীয় দিন। অন্যদিনের থেকে কি আজকের সকালটা একটু বেশি রৌদ্রজ্জ্বল মনে হচ্ছে? জরুরী অবস্থা তুলে ফেলাটা যদিও আনন্দঘন কোন ঘটনা নয়। শহরটা মৃত্যুপুরী হয়ে আছে। রিফাতের মানসিক অবস্থা তাই আমাদের জানা নেই। এ যেন অনেকটা যুদ্ধ শেষের পরে অদ্ভুত ভাবে মিশ্র কোন এক অভিজ্ঞতা, যেখানে শোক আর স্বস্তি হাত ধরাধরি করে বসে আছে চুপচাপ। তাই এই আলোকিত সকালটা যদি কোন কারণে রিফাতের ভিতর প্রতিফলিত না হয়, তাকে দোষারোপ করা যাবে না। 

কারণ আমরা জানি না এই মড়কে রিফাতের কোন আপনজন চলে গিয়েছে কিনা। তবে ইতস্তত পড়ে থাকা লাশের গন্ধ আর মৃত মানুষের বড় অংকের সংখ্যাটা দেখে যদি আমরা একটু সম্ভাব্যতার অংক করি তাহলে বুঝতে পারবো, তাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটা বাহুল্য। 

শুধু এটুকু জানাই যথেষ্ট হবে যে, মড়কের ব্যাপ্তি কমে আসায়, প্রায় ভেঙে পড়া শহরটিকে কিছুটা আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যখন সুস্থ ও জীবিত নাগরিকদের স্বেচ্ছাসেবা দেয়ার আহবান জানালো, রিফাত তখন তার আপাত শারীরিক কষ্ট পাশে ফেলে রেখে পথে নেমে যেতে খুব বেশি সময় নিলো না। 

শহরের জরুরী কাজ গুলো করার মানুষের বেশ অভাব। যাবতীয় অফিসের বারান্দায়, যেখানে থাকতো মলিন মানুষের ভীড়, কিংবা দেখা যেত দু একজন চতুর কর্মচারীকে - সে বারান্দা গুলো এখন ফাঁকা। মড়কের সাথে এসেছিল ক্ষুধার আক্রমণ- তাই শহরের শাটার নামানো দোকান গুলো কারা কখন ইদুঁরের মত সাফ করার চেষ্টা করেছে- সে তথ্য নেই কারো কাছে। ভাঙাচোরা দোকান গুলোর যা কিছু অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে মানুষের কাছে, সেগুলো ইতস্তত পড়ে আছে এদিক সেদিক। 

রিফাতের কাজ হচ্ছে এই আবর্জনা গুলো পরিষ্কার করা, ভালো জিনিস গুলো আলাদা করা এবং যেহেতু সে শিক্ষিত, তাই দোকান গুলোর ক্ষয়ক্ষতির উপর সার্ভে করা। সে একা নয়। তার সাথে আরো কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক আছে। আরো একদল স্বেচ্ছাসেবীরা বাড়িতে বাড়িতে লাশের খোঁজ করছে। যে কর্মকর্তাটি কাজ বন্টন করে দিচ্ছিলো সে প্রথমে রিফাতকে এই দলে ভীড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু লাশের প্রতি আলাদা কোন ভালোবাসা নেই বলে অথবা হঠাৎ করে কোন লাশকে পরিচিত মনে হতে পারে বলে সে ওই পথে যায়নি। 

এই কাজটি যে খুব আগ্রহ নিয়ে করছে তা নয়। এতদিন ঘরে বসে থেকে 'কিছু একটা' করার তীব্র তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। রিফাতের কাছে মনে হচ্ছে, তার বয়স বেড়ে গেছে কমপক্ষে দশ বছর! মাত্র কয়েকটা মাসকে কেন এত বছরের সমান দীর্ঘ মনে হচ্ছে? সেই কারণটি আমাদের জানা নেই। তবে আমরা ধারণা করতে পারি, মৃত্যু আর হাহাকার প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমাদের বয়স বাড়িয়ে দেয়। মৃত্যুর যে সর্বগ্রাসী আনন্দ শুষে নেয়ার তীব্র ক্ষমতা আছে সেটা আমাদের প্রাণোচ্ছলতা আর জীবনীশক্তিকে নি:শেষ করে দেয়। নিজেকে মনে হয় একজন বুড়ো মানুষ। 

রিফাত এই প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া, এলোমেলো শহরে হাঁটতে থাকে। যন্ত্রের মত কাজ করতে থাকে। কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে না। আমাদের কাছে মনে হতে পারে, যেন সে কথা বলতে ভুলে গেছে। 

অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নরম কিছুতে পা পড়ে তার। একটা মরা ইঁদুর! রিফাতের শরীরের চাপে থেঁতলে যায় ওটা। সমস্ত শরীর যেন কেঁপে ওঠে রিফাতের। একটা অদ্ভুত বিবমিষা তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপকে জাগিয়ে দেয় যেন। আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাবো, কেন যেন সে হঠাৎ করে দৌঁড়াতে শুরু করে। মনে হতে পারে, থেতলে যাওয়া মরা ইঁদুরটা যেন ওকে ধাওয়া করেছে। কিন্তু ইঁদুরটা তো রাস্তায় নয়, রয়েছে ওর মাথার ভিতরে। দৌড়ে কি তার থেকে পালানো সম্ভব? 

রিফাত হাপিয়ে যায়। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে লক্ষ করে তার জন্য নির্ধারিত এলাকা ছেড়ে সে অন্য দিকে এসে পড়েছে। জায়গাটা চিনতে পারে না। মনে হচ্ছে, এই জায়গাটা যেন শহরের বাইরে। একটু গোছালো, ঝড়ের প্রকোপ কোন কারণে কম পড়েছে এখানে। কিন্তু এখানেও মড়কের নিস্তব্ধতা। ঝড় যেখানে পৌঁছাতে পারে না, মড়ক পৌঁছে যায় সেখানেও। 

রিফাত লক্ষ করলো এখানে সব বাদ্যযন্ত্রের দোকান।  একারণে হয়তো এখানে ক্ষুধার্ত মানুষ কিংবা ইঁদুর হানা দেয়নি। মৃত্যুকে পাশে নিয়ে সুরের খোঁজ কে করবে? সুরে কি ক্ষুধা মেটে? গান কি খাওয়া যায়? 

কিন্তু তারপরেও কোন লোভী মানুষ অথবা পথের কুকুর কয়েকটা দোকান খেয়ে ফেলতে চেয়েছিল হয়তো। হয়তো নগদ কিছু লাভের আশায়। ভাঙাচোরা বাদ্য যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে একটা জায়গায়। রিফাত সেদিকে এগিয়ে যায়। 

অর্ধ ধ্বংস প্রাপ্ত বাদ্যযন্ত্রের দোকানে প্রবেশ করে সে। দেয়ালে ঝোলানো একটা গিটার দেখে চোখ চকচক করে ওঠে তার- দীর্ঘ দশ বছর অথবা কয়েকটা মাস পর এই প্রথম সেই ঝলকানিটা দেখা যায়। আমরা যদি এই অবস্থায় রিফাতকে দেখতে পেতাম তাহলে তার এই চাঞ্চল্য আমাদের মধ্যেও হয়তো সঞ্চারিত হত। রিফাত অক্ষত গিটারটা হাতে তুলে নেয়। 

রাস্তার ধ্বংসস্তূপের ভিতরে বসে গিটারের তারে তার শীর্ণ আঙুল গুলো ছোঁয়ায় সে। একটু ভালো করে লক্ষ করলে হয়তো আমরা ধারে কাছেই খুঁজে পাবো কোন মরা প্রাণী দেহাবশেষ- ইঁদুরের,  কুকুরের কিংবা মানুষের। কিন্তু রিফাতের যেন তাতে কোন ভাবান্তর হয় না। 

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে, কয়েক গজ দূরে লাশের গন্ধ নিয়ে, সে গিটারে সুর তুলতে থাকে। কান পাতলে সেই সুর শোনা যাবে বহু দূর থেকে। 


মন্তব্যসমূহ